বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০২ অপরাহ্ন
ইলিয়াস আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি : একসময় ভাড়া বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করলেও এখন ময়মনসিংহ শহরে চারটি বাড়ির মালিক মাউশির পিয়ন রইছ উদ্দিন শ্যামল ওরফে বাবু। প্রথম স্ত্রীকে ভালোবেসে দুই কোটি টাকা মূল্যের একটি পাঁচতলা বাড়ি উপহারও দিয়েছেন তিনি। তবে ভালোবাসায় ফাটল ধরায় দ্বিতীয় বিয়ে করেও সুখী হতে পারেননি বাবু। ২০০৪ সালে সরকারি বিদ্যালয়ে পিয়ন পদে চাকরি পাওয়া বাবু’র এমন বিলাশী জীবন—যাপনে আশ্চর্য এলাকাবাসী। চাকরিতে নানা অনিয়ম—দুনীর্তি করার পাশাপাশি নিজের সম্বন্ধীর সাথেও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে বাবুর বিরুদ্ধে।
ময়মনসিংহ নগরীর গোয়াইলকান্দি এলাকায় নির্মিত পাঁচতলার একটি বাড়িতে বসবাস করেন রইছ উদ্দিন শ্যামল ওরফে বাবু’র প্রথম স্ত্রী হাসিনা খাতুন। ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে ৭—৮ বছর আগে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে তিন শতাংশ জায়গায় স্ত্রীর নামে হাসিনা ভিলা নিমার্ণ করেন বাবু। এছাড়া নগরীর বাদেকল্পা এলাকায় ৬ শতাংশ জায়গায় নির্মিত আলিশান ৭তলা ভবনের তৃতীয় তলায় দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। এর পাশেই ১৩ শতাংশ জায়গায় রয়েছে একতলা আরেকটি বাড়ি। এই এলাকায় আরও দুটি স্থানে জায়গা রয়েছে বাবুর। ঘুরেন প্রিমিও মডেলের একটি প্রাইভেটকারে করে। এলাকাবাসী ও শিক্ষকদের অভিযোগ, পিয়ন থেকে কম্পিউটার অপারেটর পদে পদোন্নতি পেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপপরিচালকের (ডিডি) কার্যালয়ে যোগদানের পর শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ফাইল নয়ছয় করে টাকা কামানো শুরু করেন বাবু। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে ১০ হাজার থেকে শুরু ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। অবৈধ টাকা কামানোর পাশাপাশি রকেট গতিতে পেয়েছেন পদোন্নতি।
শ্বশুরের জায়গা কিনে ভালোবেসে স্ত্রীর নামে বাড়ি করে দিলেও বাবু প্রতারণা করেছেন সম্বন্ধী নজরুল ইসলামের সাথে। হাসিনা ভিলার নিচতলা নজরুলকে দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি দেননি।
নজরুল ইসলাম বলেন, একসময় খুব কষ্ট করে বাবুর পরিবার চলতো, ২০০৪ সালে নিজের পকেট থেকে একজনকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি। চাকরি পাওয়ার পর তাঁর আচার—আচরণ বদলে যেতে থাকে। আমাদের পরিবারের চার শতাংশ জায়গায় পাঁচতলা করার সিদ্ধান্ত নিলে বোনের কথা চিন্তা করে বাবুর কাছে জমিটুকু শর্ত সাপেক্ষে বিক্রি করে দেই। সেসময় কথা ছিল পাঁচতলার নিচতলা পুরোটা আমাকে দিয়ে দিবে; কিন্তু সে সাদা স্ট্যাম্পে আমার কাছ থেকে সই নিয়ে বেঈমানী করেছে। বিচার আল্লাহর কাছে দিয়ে রেখেছি।
তিনি আরও বলেন, বাবু শুধু আমার সাথে প্রতারণা করেনি; মানুষের কাগজপত্র ঠিকঠাক করার কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে কামিয়েছে। তার বাবা রবি উল্লাহ ক্যান্টনমেন্টে নামে মাত্র একজন ঠিকাদার ছিল, কিন্তু বাবু এখন কি করে এতো টাকার মালিক হল তা প্রশ্ন সকলের?
বাদেকল্পা এলাকার নূরুল আলম বলেন, এই এলাকায় সাততলা বাসা প্রথমবারের মতো বাবুই করছেন। শুনেছি তিনি পিয়নের চাকরী করেন তাহলে এতো টাকা পয়সার মালিক কিভাবে হলেন? শুধু সাততলা নয় পাশেই ১৩ শতাংশ জায়গার মধ্যে একটি নান্দনিক একতলা বাড়ি করেছেন। এরপাশে বাউন্ডারী করা পাঁচ শতাংশ জায়গা কিছুদিন আগে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। এর কিছুদিন আগে আরও ৬ শতাংশ জায়গা বিক্রি করেছেন। এলাকায় আসেন বড় অফিসারের মত, প্রাইভেটকারে চড়ে। মাঝেমধ্যে মোটরসাইকেলেও আসেন, তবে তিনি কারো সাথে বেশি কথা বলেন না।
একই এলাকার মো.শহীদ বলেন, পিয়ন কোটিপতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আচার—আচরণ বদলায়নি। সাততলা বাসার তৃতীয়তলায় স্ত্রী—সন্তান নিয়ে থাকলেও প্রতিদিন ঝগড়া শোনা যায়। সংসারে তাদের শান্তি নেই। শুনেছি বাবু সম্প্রতি মাদক সেবনেও জড়িয়েছে। তাহলে এসব সহায়—সম্পদ দিয়ে কি হবে বলেন?
শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, আমার এমপিও ফাইল সম্পন্ন করার জন্য বাবুকে দুই কিস্তিতে ১ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। টাকা দেওয়ার আগে নানান সমস্যা ছিল ফাইলে, কিন্তু টাকা দেওয়ার পর সবকিছু দ্রুত ঠিক হয়ে যায়। বাবুর দুনীর্তির জন্য দায়ী যারা চেয়ারে বসে আছেন তারাই, আদৌ কি আমরা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছি, না কিছু করতে পারছি। যেদিন পারব সেদিন হয়তো দুনীর্তি বন্ধ হবে।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে চড়াও হন বাবুর মা ডলি আক্তার। তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, আপনারা আমার বাড়ির সামনে থেকে বের হন। কে কি ভাবে বাড়ি করেছে তা কি আপনাদের কাছে কয়ফিয়ত দিতে হবে? আমার সাহেব একজন বড় ঠিকাদার।
২০০৪ সালে নভেম্বরে পিয়ন পদে চাকরি শুরু করলেও বাবু এখন উচ্চমান সহকারী হিসেবে ময়মনসিংহ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাইস্কুলে কর্মরত রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাড়ি—গাড়ির মালিক হওয়ার রহস্য জানতে চাইলে চটে যান বাবুও। তিনি বলেন, কত সাংবাদিক আইলো গেলো আমার কিছুই হইলো না। আর হবেও না। সম্প্রতি দুনীর্তি দমন কমিশন (দুদক) আমাকে ডেকে ছিল। আমার হিসাব ক্লিয়ার থাকায় তারা আমাকে ছেড়েও দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে অযথা লিখে কোন লাভ নেই। এসব সম্পদ আমার বাবার আর বাবার মানেই আমার কারণ আমি তাঁর একমাত্র ছেলে সন্তান।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপ—পরিচালক রওশন আরা খান বলেন, সম্পদ লোকানোর কারও কোন সুযোগ নেই। সরকারের সম্পদ বিবরণী ফরম পূরণ করে দিলেই বাবুর সকল কিছু সামনে চলে আসবে। যদি তা অসম্ভব মনে হয় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।